Recents in Beach

হালাল উপার্জন ও তার গুরুত্ব | মাহমুদুল হাসান নিহাদ

 হালাল উপার্জন ও তার গুরুত্ব 

মাহমুদুল হাসান নিহাদ 

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মানুষের মৌলিক চাহিদা। এগুলোর যোগান দিতে মানুষকে বেছে নিতে হয় সম্পদ উপার্জনের নানাবিধ পন্থা। জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ যেসব পেশা অবলম্বন করে তা হলো: কৃষি, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরী, শিল্প প্রভৃতি। উপার্জনের মাধ্যম ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষেই উপর্যুক্ত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। মানুষকে মহান আল্লাহ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব হিসেবে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদের যাবতিয় মৌলিক অধিকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। 


উপার্জনের গুরুত্ব: 

উপার্জন ব্যতীত জীবিকা নির্বাহ করা যায় না এবং ইসলামে পরিশ্রমের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তিতে নয়! আল্লাহ তা'আলা ফরয ইবাদত সমাপনান্তে জীবিকা নির্বাহে উপার্জন করার লক্ষ্যে যমিনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:

 فإذا قضيت الصلوة فانتشروا في الأرض وابتغوا من فضل الله واذكروا الله كثيرا لعلكم تفلحون) [الجمعة: 10]

“সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে, এবং আল্লাহকে অধিক স্মরন করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা জুমুআ ১০) 

এখানে অনুগ্রহ সন্ধান করা মানে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম গ্রহণ করা। (তাফসীরে কুরতুবী:খ.১৮,পৃ.৯৬) 

উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম নিজ হাতে উপার্জন করাকে সর্বোত্তম উপার্জন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ মর্মে হাদীসে এসেছে:

 عن رافع بن خديج، قال: قيل: يا رسول الله، أي الكسب أطيب؟ قال: عمل الرجل بيده وكل بيع مبرور 

হযরত রাফে ইবনে খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন: ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্দ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয় বিক্রয়।”(মুসনাদে আহমাদ:খ.৪, পৃ.১৪১) 

উপার্জন করার মনোবৃত্তি ব্যতিরেকে যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয়, তাদের এ ধরনের পেশাকে অবৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায় সে কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখমণ্ডলে এক টুকরো গোশতও থাকবে না। [বুখারী, হাদীস নং ১৪৭৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৪০।” 

ইসলাম মানবতার ধর্ম। দুস্থ মানবতার সেবায় দান করার রীতি ইসলামে চালু আছে। তবে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে ইসলাম অনুমোদন দেয় নি। সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন,

 إنك أن تدع ورثتك أغنياء خير من أن تدعهم عالة يتكففون الناس في أيديهم 

“তোমাদের সন্তান সন্তুতিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বী রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম।” [বুখারী, খ- ১, হাদীস নং ৫২] 

হালাল উপায়ে উপার্জনের ব্যবস্থা গ্রহণও অন্যতম একটি মৌলিক ইবাদত। শুধু তাই নয়, ইসলাম এটিকে অত্যাবশ্যক (ফরয) কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস প্রনিধানযোগ্য। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 كسب الحلال فريضة بعد الفريضة 

“ফরয আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও ফরয।”[বাইহাকি] 

“হে মানুষ! পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়্যেব যা রয়েছে তা থেকে আহার কর। আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।[সূরা আল-বাকারা: ১৬৮]

মহান আল্লাহ বলেন: 

( ولا تأكلوا أمولكم بينكم بالبطل وتدلوا بها إلى الحكام لتأكلوا فريقا من أمول الناس بالإثم وأنتم تعلمون )[النساء: ۲۹] 

“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দাংশ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকগণের নিকট পেশ করো না”।[সূরা আল-বাকারাহ্: ১৮৮] 

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব:

   রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: “মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোন উৎস থেকে সম্পদ আহরন করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করবে না।”[বুখারী, হাদীস নং ২০৫৯] 

হালাল উপার্জন ব্যতীত দুআ বা ইবাদত কবুল হবে না। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআল পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের।” আল্লাহ মার্চ-ডিসেম্বর ২০২০ তা'আলা বলেন: “হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুথী হিসেবে দান করেছি।" অতঃপর রাসূল সা. এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছেঃ হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ। অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?”|সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১০১৫) 

কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে তার উপার্জনের উৎস সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। সেজন্য মুমিনের জন্য হালাল উপার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে হাদীসে উল্লেখ আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন,

 لا تزول قدم ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس، عن عمره فيم الهناه، وعن شبابه فيم أبلاه، وماله من أين اكتسبه وفيم الفقه، وماذا عمل فيما علم ‘

‘কিয়ামতের দিনআদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও স্বস্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না। 

১. তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে, 

২. যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে, 

৩. ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, 

৪. তা কিভাবে ব্যয় করেছে, 

৫. সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।"[তিরমিযী, খ- ৪, হাদীস নং ২৪১৭] 

হালাল উপার্জন করার জন্য প্রয়োজনে বিদেশেও যেতে হতে পারে। সেজন্য এটিকে কুরআন মাজীদে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সাথে হালাল উপার্জনকে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

 و اخرون يضربون في الأرض يبتغون من فضل الله وع اخزون يقتلون في سبيل لله ) [المزمل: ۱۲۰ 

‘‘আর কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে, আর কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াই করবে।”[সূরা আল-মুযযাম্মিল: ৭৩:২০] 

হালাল উপার্জন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন: 

  পৃথিবীর জীবন নির্বাহে হালাল উপার্জন করার সুযোগ বা যোগ্যতা লাভ করা আল্লা তাআ'লার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামাত। সেজন্য হালাল পন্থায় উপার্জনকারী পরকালে জান্নাতে যাবে। আর অবৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়লেও পরকালীন জীবনে তার জন্য ভয়াবহ আযাব ও শাস্তি অপেক্ষা করছে। হাদীসে এসেছে,

 أربع إذا كن فيك فلا عليك ما فاتك من الدنيا حفظ أمانة وصدق حديث وحسن خليقة وعفة في طعمة 

‘‘চারটি জিনিস যখন তোমার মধ্যে পাওয়া যাবে তখন দুনিয়ার অন্য সব কিছু না হলেও কিছু যায় আসে না। তা হলো, আমানতের সংরক্ষণ, সত্য কথা বলা, সুন্দর চরিত্র, হালাল উপার্জনে খাদ্যগ্রহণ”[মুসনাদ আহমাদ, খ- ২, পৃ. ১৭৭, হাদীস নংঃ ৬৬৫২] 

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

 من أكل طيبا، وعمل في سنة، وأمن الناس بوائقه دخل الجنة 

“যে ব্যক্তি হালাল উপার্জিত খাবার খায় ও সুন্নাতের উপর আমল করে এবং মানুষ তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। [ তিরমীযি, খ- ৪,পৃ. ৬৬৯, হাদীস নং ২৫২০] 

অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনকারীর জন্য জাহান্নাম অবধারিত। ইবনে আব্বাস রা.বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. বলেছেনঃ

 كل جسد نبت من سحت فالنار أولى به 

“আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম।”(তাবারানী) কাব ইবন উজরাহ রা. রাসূলে কারীম সা. থেকে বর্ণনা করেন:

 لا يدخل الجنة جسد غذي بخرام 

“যে শরীর হারাম পেয়ে হরষ্ট পুষ্ট হয়েছে, তা জান্নাতে যাবে না।"[মুসনাদ আবী ইয়া'লা,খ.১পৃ.৮৪] 

আল্লাহ আমাদের হালাল উপার্জনের তাওফিক দিন। ইসলাম বুঝার ও মানার পথ সহজ করে দিন । আমীন!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ