Recents in Beach

হজ্জ এর আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ কী? হজ্জ কার ওপর ফরজ ও কার ওপর ফরজ নয়? হজ্জ কী তাৎক্ষণিক আদায় করা ওয়াজিব নাকি বিলম্বের সাথে? এ ব্যপারে মতপার্থক্য কী? বিস্তারিত বর্ণনা কর।

প্রশ্ন : হজ্জ এর আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ কী? হজ্জ কার ওপর ফরজ ও কার ওপর ফরজ নয়? হজ্জ কী তাৎক্ষণিক আদায় করা ওয়াজিব নাকি বিলম্বের সাথে? এ ব্যপারে মতপার্থক্য কী? বিস্তারিত বর্ণনা কর।

উত্তর :

উপস্থাপনা : মুসলিম জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ববৃহৎ মহাসম্মেলন হলো হজ্জ; যা ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। এ পুণ্যময় হজ্জ মুসলিম জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ঐক্য এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ সৃষ্টির প্রকৃষ্ট নিদর্শন। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিমদের উপর হজ্জ ফরজ, যা অবশ্য পালনীয়। তবে হজ্জ ফরজ হওয়ার পর এটা তাৎক্ষণিকভাবে নাকি বিলম্বের সাথে আদায় করা হবে, এ বিষয়ে মতানৈক্য বিদ্যমান। নিম্নে প্রশ্নালোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

হজ্জের পরিচিতি :

হজ্জের আভিধানিক অর্থ : حج শব্দটি দু'ভাবে পাঠ করা যায়। যথা-
ক. الحج শব্দের 'হা' বর্ণে যবর যোগে اؘلٛحؘجُّ  পড়া। যেমন মহান আল্লাহর বাণী- الحج اشهر معلؤمات তখন শব্দটি বাবে نصر-এর মাসদার হবে।
খ. الحج শব্দের 'হা' বর্ণে যেরযোগে اؘلٛحؚجُّ পড়া। যেমন মহান আল্লাহর বাণী- ولله على الناس حج البيت তখন শব্দটি ইসম হবে। আভিধানিক দৃষ্টিকোণে হজ্জ শব্দের অর্থ হলো-
১. القصد والارادۃ তথা ইচ্ছা ও সংকল্প করা।
. الزيارۃ তথা সাক্ষাৎ করা।
৩. القصد الى شئ عظيم তথা মহৎ জিনিসের প্রতি ইচ্ছা করা।
. আযহারী (র) বলেন- الزيارۃ والاتيان তথা সাক্ষাৎ ও আগমন করা।
৫. القصد للنسك তথা হজ্জ বা ইবাদতের ইচ্ছা করা।
৬. القصد لزيارۃ بيت الحرام তথা বায়তুল্লাহ যিয়ারতের ইচ্ছা পোষণ করা।
. ইংরেজিতে- To make decision, To visit ইত্যাদি।

হজ্জের শরয়ী/পারিভাষিক অর্থ :
. শরহে বেকায়াহ গ্রন্থের টীকাকারের মতে- الحج هو زيارۃ مكان مخصوص فى وقت مخصوص অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থান যেয়ারত করার নামই হজ্জ।
. আল কামূসুল ফিকহী গ্রন্থপ্রণেতার ভাষায়- هُو قَصْدُ الْبَيْتِ الْحَرَامِ لِلتَّفَرِبِ إِلى اللهِ تَعَالَى بِأَفْعَالٍ مَخصُوصَةٍ فِي زمان مخصوص ومكان مخصوص অর্থাৎ, মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে ও স্থানে নির্দিষ্ট কার্যাবলির মাধ্যমে সম্মানিত বায়তুল্লাহ যেয়ারতের সংকল্প করাকে হজ্জ বলা হয়।
. তানযীমুল আশতাত গ্রন্থকারের মতে- الحج هو القصدُ إِلى زِيَارَةِ البيتِ الحَرَامِ عَلَى وَجْهِ التعظيم بافعال مخصوصةٍ فِى زمانٍ مخصوص . অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত নিয়মে সসম্মানে বায়তুল্লাহ যেয়ারতের ইচ্ছা করাকে হজ্জ বলে। 
. ওমদাতুল কারী প্রণেতার ভাষায়- নির্দিষ্ট কার্যাবলির দ্বারা সম্মানের সাথে বায়তুল্লাহ যেয়ারতের ইচ্ছা করাকেই হজ্জ বলে। 
. কানযুদ দাকায়েক গ্রন্থকার বলেন- الْحَج هُو زيارة مَكَانِ مَخصُوصِ فِى وقتٍ مَخْصُوص بِطَرِيقٍ مَخْصُوص با فعال مخصوصة . 
. ফাতহুল কাদীর প্রণেতার ভাষায়- هو زيارة البيت مع الإحرام والوقوفِ بِعَرفَةَ فِى وقتِ مَعْلُومٍ . 
. জাওয়াহিরুল ফিকহ গ্রন্থকারের ভাষায়- الْحَج هُو زيارة مكانٍ مَخصُوص فى وقتِ مَخصُوصِ بِطَرِيقِ مَخصُوص . অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থান, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যেয়ারত করার নামই হজ্জ।
৮. কেউ কেউ বলেন - Hazz means making the pilgrimage to Macca.

হজ্জ কার ওপর ফরজ ও কার ওপর ফরজ নয় : 

নিম্নোক্ত শর্তাবলি যার মাঝে বিদ্যমান থাকবে, তার ওপর হজ্জ ফরজ। যেমন-

. السلام তথা মুসলিম হওয়া : কেননা অমুসলিমের ওপর হজ্জ ফরয নয়। অমুসলিম অবস্থায় হজ্জ করলেও ইসলাম গ্রহণের পর পুনরায় তাকে হজ্জ আদায় করতে হবে। মক্কা বিজয়ের পর থেকে অমুসলিমদের ওপর তাওয়াফ ও হজ্জ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। যেমন আল্লাহ তায়ালার বাণী- থাকবে, তার ওপর হজ্জ ফরয। যেমন- انماالمشركون نجس فلا يقربوا الْمَسْجِد الْحَرَامَ .ـ 
২. الحريۃ তথা স্বাধীন হওয়া : দাস সেবা, কিংবা যে কোনো প্রকারের হোক না কেন, তাদের প্রতি হজ্জ ফরয নয়। দাসদাসীর প্রতি হজ্জ ফরয না হওয়ার মৌলিক কারণ হলো, তারা استطاعۃ তথা স্বীয় ইচ্ছার প্রতি সামর্থ্যবান নয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী-عبدا مملوكا لا يقدر على شئ 
৩. مكلف بالشرع  তথা বালেগ হওয়া : কেননা নাবালেগ, অপ্রাপ্তবয়স্ক, মস্তিষ্ক বিকৃতদের ওপর হজ্জ ফরয নয়। যেমন মহানবী (স)-এর বাণী- رفع القلم من ثلاث عن الصبي حتى يبلغ .
৪. الصحۃ  তথা সুস্থ হওয়া : স্বাস্থ্যগতভাবে পূর্ণ সুস্থ না হলে তার ওপর হজ্জ ফরয নয়। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী, দুর্বল, যানবাহনে আরোহণে অক্ষম ব্যক্তির ওপর হজ্জ ফরয নয়। যেমন মহান আল্লাহর বাণী ليس على الضعفاء ولا على المرضى 
৫. البصارۃ  তথা দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হওয়া : কেননা অন্ধ ব্যক্তির ওপর হজ্জ ফরয নয়, যদিও তার পথপ্রদর্শক থাকে। যেমন মহান আল্লাহর বাণী  ليس على الاعمى حرج
৬. الزاد  তথা পাথেয় থাকা : হজ্জকারীর সম্পদের পরিমাণ ততটুকু হতে হবে, যাতে আসা যাওয়ার সমস্ত খরচের পর বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবার পরিজনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে পারে। সুতরাং এ পরিমাণ সম্পদ কারো নিকট না থাকলে তার ওপর হজ্জ ফরয নয়।
৭. امن الطريق তথা রাস্তা নিরাপদ হওয়া : রাস্তা নিরাপদ না হলে বা রাষ্ট্রীয় কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকলে বা কোনো যুদ্ধবিগ্রহ, চোর-ডাকাত বা হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ অথবা শত্রুর ভয় থাকলে হজ্জ ফরয হবে না।
৮. الزوج او المحرم للمرأۃ তথা মহিলার সাথে স্বামী বা মাহরাম পুরুষ থাকা : যদি তার বাড়ি থেকে কাবাঘরের দূরত্ব ৪৮ মাইল বা এর চেয়ে বেশি হয়, তাহলে তার সাথে زوج  বা কোনো محرم তথা বিবাহবন্ধন হারাম এমন পুরুষ থাকতে হবে, অন্যথা তার ওপর হজ্জ ফরয হবে না। যার স্বামী নেই কিংবা মাহরামের খরচ বহনের ক্ষমতা নেই, তার প্রতি হজ্জ ফরয নয়। যেমন মহানবী (স)-এর বাণী- لا تحجن امرأۃ الا ومعها ذو محرم 
.راحله  তথা যানবাহনের সুবিধা থাকা : কেননা যানবাহনের সুবিধা না থাকলে হজ্জ ফরয হবে না।
১০. العاقل  তথা জ্ঞানবান হওয়া কেননা পাগলের ওপর হজ্জ ফরয নয় । 
১১. কয়েদি না হওয়া : কারাবন্দির ওপর হজ্জ ফরয নয়। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি প্রেরণ করাও জরুরি নয়। তবে অন্য বর্ণনা মতে, তারা প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে হজ্জ আদায় করতে পারবে। উপরিউক্ত শর্তাবলির যে কোনো একটি অনুপস্থিত থাকলে ব্যক্তির ওপর হজ্জ ফরয হবে না। 

: هل الحج واجب على الفور ام على التراخي .
হজ্জ তাৎক্ষণিক না বিলম্বের অবকাশসহ ওয়াজিব : মহান আল্লাহর ঘোষণা- ولِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حج البيتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا. এ ঘোষণা অনুযায়ী সকল আলেম ও ফকীহ ঐকমত্য পোষণ করেন যে, সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর জীবনে একবার হজ্জ আদায় করা ফরয, যা মৃত্যুর পূর্বে অবশ্যই পালনীয়; কিন্তু কারো ওপর হজ্জ ফরয হওয়ার পর তা আদায় করা কি ঐ বছরই ফরয, নাকি তাতে বিলম্বের অবকাশ রয়েছে, এ ব্যাপারে ইমামগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। যেমন- 
১. ইমামত্রয়ের অভিমত : ইমাম আবু হানীফা, শাফেয়ী ও মুহাম্মদ (র)-এর মতে, হজ্জ على التراخي তথা বিলম্বের অবকাশসহ ফরয। 
দলীল : তাঁদের দলীল হলো- 
ক. যেসব শব্দ দ্বারা হজ্জ ফরয হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেমন-اتموا الحج  (الايۃ) এবং فحجوا (الحديث)  এগুলো امر مطلق যা তাৎক্ষণিক পালন করা ফরয হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে না।
খ. হজ্জ্ব ষষ্ঠ বা নবম হিজরীতে ফরয হয়েছে, আর রাসূল (স) হজ্জ আদায় করেছেন দশম হিজরীতে। আদায় যদি তাৎক্ষণিকভাবে পালনীয় হতো, তাহলে রাসূল (স) বিলম্বে আদায় করতেন না। 
গ. সালাতকে যেমন শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত বিলম্ব করা যায়, হজ্জকেও তেমনি বিলম্ব করা যাবে।
২. মালেক, আহমাদ ও আবু ইউসুফের অভিমত : ইমাম মালেক, আহমাদ ও আবু ইউসুফ (র)-এর মতে, হজ্জ على الفور তথা ফরয হওয়ার সাথে সাথে ঐ বছরই আদায় করা ফরয।
দলীল : তাঁদের দলীল হলো- 
ক. মহানবী (স)-এর বাণী-من اراد الحج فليعجل  অর্থাৎ, যে ব্যক্তি হজ্জের ইচ্ছা করবে, সে যেন তাড়াতাড়ি করে। 
. জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাই তাৎক্ষণিকভাবে হজ্জ আদায় করতে হবে। 
প্রতিপক্ষের দলীলের প্রত্যুত্তর : 
ক. ইমাম আবু ইউসুফ (র)-এর পেশকৃত হাদীসের উত্তরে বলা হয়, এখানে আদেশসূচক ক্রিয়া فليعجل-টি وجوب-এর জন্য নয়; বরং استسحاب-এর জন্য। তাই তাড়াতাড়ি আদায় করা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। 
খ. জীবনের অনিশ্চয়তার অজুহাতে হজ্জকে তাৎক্ষণিক ফরয বলা যাবে না; বরং উত্তম বলা যেতে পারে।

উপসংহার : হজ্জ বিলম্বের অবকাশসহ আদায় করা যাবে, তদুপরিও তাড়াতাড়ি আদায় করাই ঈমানে দাবি ও মুস্তাহাব। কেননা হজ্জ অনাদায়ী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে গুনাহগার হতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ