Recents in Beach

মানব জীবনে আত্মসমালোচনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা | Abdullah media

 মানব জীবনে আত্মসমালোচনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতা 

মো. মোফাজ্জেল হোসেন

পার্ট-১

মানবজাতিকে আল্লাহ তাআলা আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ আসনে সমাসীন করেছেন। এবং আমাদেরকে জ্ঞান ও স্বাধীন চিন্তাশক্তি দান করেছেন। আর এই চিন্তা শক্তির স্বাধীনতার কারণে মানুষের মধ্যে তিন ধরণের নফসের সম্মিলন ঘটেছে। নফসে আম্মারাহ নফসে লাউওয়ামাহ এবং নফসে মুতমাইন্নাহ। এর মধ্যে নফসে আম্মারাহ মানুষকে জৈবিক কামনা-বাসনা ও দুনিয়ার লোভ-লালসার দিকে আকৃষ্ট করে তাকে সদা সর্বদা মন্দকাজের দিকে ধাবিত করে। মন্দকাজ মানুষের অন্তরকে কঠিন ও শক্ত করে তোলে ফলে সে ইসলাম থেকে দুরে চলে যায়। ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি সত্ত্বার জন্য নিজের কৃত কর্মের হিসেব গ্রহণ করা এবং অনুশোচনা ও তাওবা, ইস্তিগফারের মাধ্যমে সে সকল কার্য থেকে বেঁচে থাকা একান্ত জরুরী । আর আত্মসমালোচনা ব্যক্তির মাঝে পাপবোধ ও অনুশোচনা সৃষ্টি করে। তাই আত্মসমালোচনা মানব জীবনের এক অপরিহার্য বিষয়। আত্মসমালোচনা আল্লাহর পথের পথিকদের রাস্তা ও আখেরাতে মুমিনদের পাথেয় এবং সফলকাম ব্যক্তিদের দুনিয়া ও আখিরাতের পুঁজি। আর কিয়ামতের দিন যারা নাজাত পাবে তারা আত্মসমালোচনা ও প্রবৃত্তির বিরোধিতার কারণেই পাবে। পরকালে নাজাতের জন্য আত্মশুদ্ধির কোন বিকল্প নেই। আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন, قد افلح من تزکی “অবশ্যই সাফল্য লাভ করবে যে আত্মশুদ্ধি করবে”। আর এই আত্মশুদ্ধির অন্যতম মাধ্যম হলো মুহাসাবাতুল আমাল তথা আত্মসমালোচনা করা। এ কারণেই সাহাবী, তাবেয়ী, সলফে সালেহীন ও পরবর্তী উলামায়ে কিরাম সকলেই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মসমালোচনাই লিপ্ত হয়েছেন; এ সত্ত্বেও যে তারা ইলম, আমল, যুহদ, তাকওয়া, খোদাভীতি, রাত্র জাগরণ, নিশীতে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। আর নিজেদের আমলের সল্পতার দরুন নিজেদের নফসকে ভৎসনা, তিরস্কার করতেন। এমনকি হযরত রাবেয়া আদাবীয়াহ রহ. বলেছেন,(یحتاج الی استغفار کثیر استغفارنا) আমাদের ক্ষমা প্রার্থনা আরো অনেক ক্ষমাপ্রার্থনার মুখাপেক্ষী। 


আত্মসমালোচনার পরিচয় : আত্মসমালোচনা হল নিজের সম্পর্কে সমালোচনা করা। আরবীতে বলা হয়, محاسبه النفس অর্থাৎ স্বীয় আত্মার হিসাব গ্রহণ করা। ইমাম মাওয়ারিদী রহ. বলেন, আত্মসমালোচনার অর্থ হলো প্রতিদিন রাতে শয়নের পূর্বে দিনের বেলা যে সমস্ত কাজ নিজের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে সেসকল কাজের পর্যালোচনা করা। অতঃপর যে কাজটি উত্তম ও কল্যাণকর প্রতিয়মান হবে তা আগামী দিনে অব্যহত রাখা এবং নিজেকে সে সকল কাজে মগ্ন রাখা। আর যে সকল কাজ নিজের ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও অকল্যাণ বয়ে আনে, সে সকল কাজ পরিত্যাগ করা এবং যথাসম্ভব তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর আগামীতে অনুরূপ কাজে আর জড়িত না হওয়ার বদ্ধ পরিকর হওয়া।


আত্মসমালোচনার হুকুম : আত্মসমালোচনাকে প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, يا أيها الذين آمنوا اتقوا الله ولتنظر نفس ما قدمت لغد واتقوا الله إن الله خبير بما تعملون، ولا تكونوا كالذين نسوا الله فأنساهم أنفسهم أولئك هم الفاسقون “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের (পরকালের) জন্য কি প্রেরণ করেছে; তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সে বিষয়ে সম্যক অবহিত”।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, إن السمع والبصر والفؤاد كل أولئك كان عنه مسئولا নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে।

তিনি আরও ইরশাদ করেন, ما يلفظ من قول إلا لديه رقيب عتيد “সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে।'

হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, الكيس من دان نفسه وعمل لما بعد الموت، والعاجز من أتبع نفسه هواها وتمنى على الله “বুদ্ধিমান হলো সে ব্যক্তি যে ব্যক্তি স্বীয় নফসের হিসাব নেয় এবং পরকালের উদ্দেশ্যে আমল করে। আর অক্ষম হলো সে ব্যক্তি যে স্বীয় নফসের চাহিদার তাবেদারী করে, আর আল্লাহ তালার নিকট অলীক আশা পোষণ করে। " আত্মসমালোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর নিম্নোক্ত বাণীটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا، وزنوا أنفسكم قبل أن توزنوا. فإنه أهون عليكم في الحساب غذا، أن تحاسبوا أنفسكم اليوم، وتزينوا للعرض الأكبر يؤمنذ تعرضون لا تخفى منكم خافية “তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হবার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না।”

হযরত মাইমুন ইবনে মিহরান রহ. বলেন, لا يكون العبد تقيا حتى يحاسب نفسه كما يحاسب شريكه من أين مطعمه وملبسه

অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকী হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার অংশীদারের হিসাবের মত নিজের আত্মার হিসাব গ্রহণ করবেনা যে, তার খাদ্য সামগ্রী ও পোষাক পরিচ্ছদ কোথা থেকে এসেছে। (হালাল উপায়ে না হারাম উপায়ে)।


_____________________________________

১. সূরা আ'লা, আয়াত: ১৪।

২. ইমাম আবু হামে গাজালী (মৃত্যু: ৫০৫ হি.), ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন, (বৈরুত: দারুল মা'রেফা, তা.বি.), খ.১, পৃ.৩১৩।

৩. আদাবুদ্বীন ওয়াদ্ দুনিয়া, পৃ.৩৪৬।

৪. সূরা হাশর, আয়াত: ১৮। 

৫. সূরা ইসরা, আয়াত: ৩৬। 

৬. সূরা কফ, আয়াত নং-১৮।

৭. সুনানু তিরমিযী, হা. নং-২৪৫৯। 

৮. সুনানু তিরমিযী, হা. নং-২৪৫৯। 

৯. ইবনু আবিদ্দুনিয়া, আবু বকর আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ (মৃত্যু ১৮১হি.), মুহাসাবাতুন নাফস, (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১৪০৬হি./১৯৮৬খ্রি.), পৃ.২৫। 

[মানব জীবনে আত্মসমালোচনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা | পার্ট-২]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ